আমার সুরমা ডটকম: আদালত চিকিৎসার জন্য একমাত্র যুক্তরাজ্যে যাওয়ার অনুমতি দিলেও সে দেশের সরকার হাস্যকর যুক্তি দেখিয়ে ভিসা দেয়নি বলে জানিয়েছেন দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান। মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা জানান। মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে আমি সবচাইতে অধিকার বঞ্চিত একজন নাগরিক। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় আমার চিকিৎসার অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। দীর্ঘ ৫ বছর কারাভোগের কারণে আজ আমি গুরুতর অসুস্থ। বিদেশে আমার চিকিৎসার প্রয়োজন। আদালত আমার চিকিৎসার জন্য শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাজ্য হাস্যকর কারণ দেখিয়ে আমার ভিসা আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। এ ঘটনায় আমি দুঃখিত হলেও অবাক হইনি।
গত ২৩ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এটাই সংবাদ মাধ্যমে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট চিন্তক কবি ফরহাদ মজহার, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক রুহুল আমিন গাজী, বিএফইউজের সভাপতি শওকত মাহমুদ, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, আমার দেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদসহ পত্রিকাটির সংবাদকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাজ্যের ভিসা আবেদন খারিজের প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান বলেন, যুক্তরাজ্যের ভিসা কর্মকর্তা আমার ভিসা খারিজ করার হাস্যকর কারণ দেখিয়েছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, আমি নাকি যুক্তরাজ্যে গেলে নাও ফিরতে পারি। রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারি। কিন্তু আমার বয়স এখন ৬৩ বছর। যুক্তরাজ্যে থাকার চিন্তা আমি কখনোই করিনি এবং ভবিষ্যতেও করবো না। ১৯৮৬ সালে আমি প্রথম যুক্তরাজ্যে যাই। এরপর থেকে প্রতিবারই ৫ বছরের জন্য আমার ভিসা নবায়ন করা হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালে আমার চোয়ালের অপারেশনের জন্য লন্ডনে গিয়েছিলাম। তখনও আমার ওপর সরকারি দমন-পীড়ন চলছিল এবং আমি ৫০টি মামলার ভিকটিম ছিলাম। সে সময়ও লন্ডনে থেকে যাওয়ার কোনো চিন্তা আমার মাথায় আসেনি এবং অপারেশনের জন্য যে কয়দিন থাকা দরকার সেই কয়দিনই আমি সেখানে ছিলাম।
তিনি বলেন, আমার মনে হয় যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিতে আমার অপরাধ আমি কেন ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি? আজ আমি যদি ইসলামের বিরুদ্ধের শক্তি হতাম, তাহলে আমাকে ভিসা চাইতে হতোনা, ডেকে নিয়ে ভিসা দেয়া হতো। আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৭টি মুসলমান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সেখানে সফরে গেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে।
মাহমুদুর রহমান বলেন, বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এজন্য যতটুকু চিকিৎসা করা সম্ভব দেশেই করবো, বাকিটা মহান আল্লাহর ইচ্ছা। মাহমুদুর রহমান বলেন, গত ২৩ নভেম্বর কাশিমপুরের ছোট কারাগার থেকে এখন আমি বাংলাদেশ নামের বড় কারাগারে। বর্তমান সরকারের ৮ বছরের মধ্যে ৫ বছরই কারাবন্দী ছিলাম। প্রথম দফায় ১০ মাস এবং ২য় দফায় একটানা প্রায় ৪ বছর। এত দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকার ফলে আমি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হই। মেরুদণ্ড, ঘাড়, হাত ও কোমরের হাড়ের ক্ষয় রোগে আমি বিপর্যস্ত। তাই জেল থেকে বেরিয়েই ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হই। এ হাসপাতাল ও পিজির চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জামিন পাওয়ার পর আমার পাসপোর্ট আদালতে আটকে রাখা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মেডিকেল রিপোর্টসহ বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ চেয়ে পাসপোর্ট ফেরতের আবেদন জানালে আপীল বিভাগ আমাকে পরীক্ষা করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী মেডিকেল বোর্ড আমাকে পরীক্ষা করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আরো উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসার সুপারিশ করে। এ সুপারিশের প্রেক্ষিতে আপীল বিভাগ চারটি শর্তে আমাকে শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যে যাওয়ার অনুমতি দেন। এতে বলা হয়-ইউকেতে আমি ৩০ দিন থাকতে পারবো, সেখানে কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ড করতে পারবো না, ফিরে এসে পাসপোর্ট জমা দিতে হবে এবং মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পাসপোর্ট ফেরত পাবোনা।
আমার দেশ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বলেন, পাসপোর্টে লেখা আছে একমাত্র ইসরাইল ছাড়া সব দেশেই বাংলাদেশের নাগরিকদের যাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কোর্টের আদেশ অনুযায়ী শুধু যুক্তরাজ্যের জন্য প্রযোজ্য। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই’ নামে আমার একটি বই আছে। এখনো বইটি বিক্রি হয়। যুক্তরাজ্যে আমার ভিসা খারিজ এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একের পর এক সিদ্ধান্তে সেটাই আজ প্রমাণিত হচ্ছে।
নিজের লেখালেখি ও দৈনিক আমার দেশ প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি সিএমএম আদালতে আমি আমারদেশের প্রেস খুলে দেয়ার আবেদন জানিয়েছি। আমার বিশ্বাস আদালত আমার আবেদন আমলে নিয়ে প্রেস খুলে দেবে। আমারদেশ আবারো ছাপার অক্ষরে আসবে। শত শত বেকার সাংবাদিক আবারো কর্মস্থল ফিরে পাবে। আর লেখালেখি আমার বন্ধ হয়নি, লেখালেখি চলছে। জেলের মধ্যেও আমি লিখেছি এবং এখনো লিখছি। কিন্তু এ লেখা ছাপার জায়গা আজ নেই। আমার বিশ্বাস কোন একদিন এ লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছবেই।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনে দেশের মানুষ আজ দিশেহারা। যে আদর্শ নিয়ে ২০১৩ সালে আমি জেলে গিয়েছিলাম, সে আদর্শ এখনো আমি লালন করি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক-স্বাধিনতা এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থের পক্ষে আমার সংগ্রাম চলবে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, ৮৮৬ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন, ২শ মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২৬ জন সাংবাদিককে। আর আমার বিরুদ্ধে ৮১টি মামলা তো সবার জানা। এ হলো ‘স্বাধীন’ সাংবাদিকতার চিত্র। তিনি আমারদেশসহ সব বন্ধ মিডিয়াগুলো খুলে দেয়ারও দাবি জানান।